স্মৃতি রোমন্থন---আমার জান্নাতবাসিনী পিতামহী--খাদিজা বেগম
আদিমতার গন্ধ থেকে মানুষ যখন নব্য এবং সভ্য জগতে প্রবেশ করল, তখন থেকেই মোটামুটি স্বাভাবিক জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হল মানব জাতি। বেদুইন সভ্যতার অবসান ঘটিয়ে সভ্যতা এবং সংস্কৃতি লালনের প্রতি মানুষের দিক নিবন্ধ হল, এলো আধুনিকতার ছোঁয়া। আধুনিক সমাজে বসবাস মানেই পরিশ্রম। পরিবেশগত কারণেই হোক আর অভ্যাসগত কারণেই হোক, পুরুষরা সাধারণত বাইরে কাজের সন্ধানে বের হয়। পরিবারের ভার বহন করে প্রাত্যহিক জীবিকা অর্জনের মাধ্যমে। অপরদিকে নারীরা বলা যায় একই কারণে কিছুটা ঘরমুখী, পরিবার এবং সন্তান প্রতিপালনের এক মহান দায়িত্যে যেন পরিবিষ্ট তাদের সারাটা জীবন। কিন্তু সমাজ যেহেতু প্রগতিশীল, সেখানে নারীকে ছাড়া পুরুষের সাফল্যের কথা অলীক কল্পনা মাত্র। সমাজ তথা জাতি, দেশ মোট কথা পুরো পৃথিবীর সমাজ কাঠামো পরিবর্তনে নারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই তো নজরুল যথার্থই বলেছেন,
“বিশ্বে যা—কিছু মহান চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।“
নারীকে সাথে নিয়ে অনেকটা জুড়ি বেঁধে পুরুষ আজ উন্নতির চরম শিখরে। অথচ সেই সমাজেই নারীরা ছিল হতাশাজনকভাবে কোণঠাসা। কিন্তু এতে তাঁদের বিন্দুমাত্র ক্ষোভ বা আক্ষেপের ছাপ ছিল না। বরং পুরুষ তান্ত্রিক সমাজে, সমাজ বা দেশ গড়ার জন্য পুরুষের সাথে সহায়তা করতে গিয়ে যুগে যুগে অমর হয়েছেন হাজার হাজার নারী। কিন্তু তাদের মধ্যে কত জনকে আমরা মনে রাখি বা রাখার চেষ্টা করি। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক জীবনে বা সামাজিক জীবনেও ঠিক এরকম অনেকেই আছেন যারা সারাজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন অবিরামভাবে। আপন করে নিয়েছেন সবাইকে, হোক সে পাশের গ্রামের অথবা নিজের বাড়ির কেউ। সৎ এবং সরল মন দিয়ে তারা জয় করেছেন সকলের মন। আমার দাদী ছিলেন তেমনি মহীয়সী নারীদের একজন।
শৈশবে প্রতিদিন সকাল বেলা দাদির হাতের মাখানো দুধ ভাত ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার। প্রতিবার মুখে ভাত তুলে দেবার জন্য দাদি কতবার যী ভাত মাখতেন তা গুনে শেষ করা যাবে না, ভাত মুখে দেবার সাথে সাথে এক নিমিষে তা শেষ হয়ে যেত এবং অধীর আগ্রহে পরবর্তি বারের জন্য অপেক্ষা করতাম। যতবার তিনি মুখে ভাত উঠিয়ে দিতেন ততোই ভাতের স্বাদ আরো বেড়ে যেত। দাদির কোলে বসে দাদির মুখে বিভিন্ন রাজা-রানীর গল্প ছিল ভাত খাবার আরেক মজা। দাদি আমাকে প্রতিদিন একটা করে গল্প শুনাতেন। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে যে দাদী একই গল্প পর পর দুই দিন বা তিন দিন বলে ফেলেছেন, কিন্তু আমি তা বুঝতে পেরেও কিছু বলতাম না।
আমি মাঝে মাঝে খাবারের সময় একটু বেঁকে যেতাম, খেতে চেতাম না। দাদী আমাকে বাড়ির পাশের বিরাট পুকুরের চারি পাশে ঘুরিয়ে আনতে আনতে কখন যে থালার ভাত শেষ হয়ে যেত তা বুঝতেই পারতাম না। গল্প শোনার মাঝে আমি দাদীকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতাম, এই যেমনঃ রাজার শেষ মেয়েটা দেখতে লবণের মত হল কেন? কিভাবে রাজকুমার রাজকুমারীর লম্বা চুল বেয়ে রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করল? এমনি ভাবে হাজারও প্রশ্ন মাথায় বন বন করে ঘুরত।
সকালের খাওয়া—দাওয়ার পর্ব শেষ হলে শুরু হবে খেলার পালা। সে সময় বাড়িতে কেউ থাকত না। আমি খেলা করতাম নিজের মত আর দাদী বাড়ির অন্য কাজ করতেন। আমার খেলা করার সমস্ত জিনিস পত্র দাদী দেখাশোনা করতেন। কোঙ্কিছু না পেলেই দৌড়িয়ে দাদীর কাছে চলে যেতাম। কারণ সেই ছোট্টকালেই দাদীর প্রতি চরম বিশ্বাস ছিল কোন কিছু হারালে আর কেউ না জানুক—দাদী জানবেই। আর এভাবেই দুপুর হয়ে যায়। দুপুরের রোদে খেলাধুলা বা দৌড়াদৌড়ি করতে দাদী যে আমাকে কত শত বার নিষেধ করতেন। কিন্তু আমি অপেক্ষায় থাকতাম কখন দাদী চোখের আড়াল হবে, আর সাথে সাথে এক দৌড়ে আমার খেলার সাথীদের কাছে চলে যেতাম। খেলা শেষ পুকুরে গোছল করতে যেতাম বন্ধুদের সাথেই, কারণ আমাদের ভেতর অনেক রকম প্রতিযোগিতা হত। এই যেমন কে সবার আগে পুকুরের এই পাড় থেকে অপর পাড়ে যেতে পারবে? অথবা এক দমে কে কতক্ষণ পানির নিচে ডুব দিয়ে থাকতে পারে। ঠিক এমন সময় পাশের বাড়ির কোন চাচী বা ফুফু হয়ত বলবে, ঐ দেখ, তোমার দাদী আসছে লাঠি হাতে। এইবার আর যাই কোথায়? সাথে সাথে এক ডুব সাতারে পুকুরের অপর পাশে গিয়ে, মাঠ পেরিয়ে এক দৌড়ে বাসায় এসে, ঘরের দরজা দিয়ে চুপ করে বসে থাকব। কিন্তু পরক্ষণেই শুধু অবাকই না, অনেকটা বিস্মিত হয়ে যেতাম যখন শুনতাম দরজার ওপাশ থেকে দাদীর গলা “ এই দরজা খুলে বাইরে এসে জামা-প্যান্ট বদলাও’ আমি বুঝতাম না কিভাবে দাদী আমার ঘরের ভেতর লুকিয়ে থাকা টের পেয়ে যেত। ততক্ষণে ভেজা হাফপ্যান্ট এবং জামার পানিতে ঘরের মেঝের অবস্থা নাজুক। দরজা খুলতেই ঘরের মেঝের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই দাদী, আর কিছু বলতেন না।
এদিকে দুপুরের খাবার সময় হয়ে এলো। “দাদি, ভাত খাব” বললেই দাদির হাজারো কাজের মাঝে ছুটে এসে আমাকে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে ভাত বেড়ে, মাখিয়ে খাইয়ে দিতেন। ঊল্লেখ্য, আমার আম্মু এবং আব্বু দু জনেই চাকরীর কারণে সারা দিন বাড়ির বাইরে থাকতেন, ফলে শৈশব এবং কৈশরের একটা ব্যাপক অংশ আমি দাদির সাথেই কাটিয়েছি। যাই হোক, এবার ঘুমানোর পালা। আর সে তখন দুপুরে ঘুমানোটা ছিল আমার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। আমি বিছানায় চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান করে শুয়ে থাকতাম, আর মাঝে মাঝে চোখ খুলে দেখতাম দাদি নামাজের জন্য বসেছেন কি না। যেই না দেখি দাদি নামাজ পড়তে বসেছেন, সাথে সাথে এক লাফে ঊঠে দৌড়ে পাশের পাড়ার বন্ধুদের সাথে আবার খেলাধুলার আয়োজন। খেলতে খেলতে কখন যে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামত তা কখনো বুঝতে পারি নি। খেলা শেষে অনেক ভয়ে ভয়ে বাসায় আসতাম কারণ ততোক্ষণে আব্বু আর আম্মু বাসায় ফিরেছেন। আব্বুকে আমি অনেক বেশী ভয় পেতাম। মাগরিবের সময় হয়েছে, তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে নিতাম, আবার কোন কোন সময় আম্মু আমাকে গোসল করিয়ে দিতেন। আম্মু গোসল করিয়ে দিলে এক অন্য রকম শান্তি অনুভব করতাম। যা হোক, মাগরিবের সময় হয়েছে, আমি দেখতাম আম্মু আর দাদি এক সাথে মিলে আমাদের হাঁস-মুরগীগুলোকে তাদের ঘরে উঠিয়ে দিতেন, মাঝে মাঝে আমিও দু একটি মুরগীর বাচ্চা ধরার চেষ্টা করতাম, কিন্তু পারতাম না, যদিও একবার কি দু বার ধরেছি, দাদি এসে তা আমার হাত থেকে নিয়ে নিতেন তিনি বলতেন আমি ধরলে নাকি মুরগির বাচ্চাকে চাপ দিয়ে মেরে ফেলব। আমি তখন ভাল করে ওযুও করতে পারতাম না, কোন রকম সেরেই আব্বুর পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম, আমি এক পাশে আর ভাইয়া আরেক পাশে। নামাজ কেন পড়ে তা কিছুই বুঝতাম না, আব্বু নামাজে কি কি বলতেন তাও জানতাম না। শুধু একটুকুই জানতাম যে, নামাজ পড়তে হয় প্রতিদিন।
নামাজ শেষে এবার দাদির কাছে আবার গল্প শোনা। দাদির কাছে গিয়ে দেখতাম দাদি নামাজ শেষ করে তসবীহ নিয়ে বসে আছেন। দাদির কোলে গিয়ে বসতাম। “দাদি, একটা গল্প শোনাও” উত্তরে দাদি বলতেন, কি গল্প শোনাব রে ভাই” আমি তখন বলতাম রাজা-রানীর গল্প। গল্প শুনতে শুনতে আম্মু রান্নাঘর থেকে আমার নাম ধরে ডাক দিতেন, “তোমার দাদিকে নিয়ে খেতে আস” খাওয়া—দাওয়ার পর ঘুমাতে যাওয়া। আম্মু বিছানা তৈরী করে দিতেন। দাদির ঘরের বারান্দায় দুটি খাট ছিল ভাইয়া আর দাদির জন্য আর আমাদের ঘরে আমি আম্মু আর আব্বু থাকতাম। প্রতিদিন বিছানার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে গড়াগড়ি দেওয়া ছিল আমার অভ্যাস। আম্মুর তৈরী করা বিছানাতে গা এলিয়ে দিতেই এক প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যেত শরীরের ভেতর দিয়ে। আর পরক্ষণেই হারিয়ে যেতাম ঘুম নগরে।এভাবেই চলে যেত দিন সপ্তাহ, মাস, বছর।
দাদির একটা বড় গুন ছিল যে তিনি বছরের বিভিন্ন সময়ে নানা রকম পিঠা বানাতেন। আম্মু চাকরির কারণে হয়ত সময় করে উঠতে পারতেন না, কিন্তু দাদি সেগুলোকে বেশ ভালো ভাবেই ম্যানেজ করে নিতেন।
আমি আমার দাদিকে কোন দিন দেখি নি নামাজ কাজ্বা করতে। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ। তিনি নিজের পরিবারের সাথেই তো বটেই প্রতিবেশীদের সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। মানুষকে আপ্যায়নে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। মানুষকে আথিতিয়তার মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন পরম শান্তি। যতদিন তিনি এ দুনিয়াতে বেঁচে ছিলেন আমাদেরকে তিনি পরম আদরের মায়াডোরে বেঁধে রেখেছিলেন বড় আপন করে। আমার বা পরিবারের অন্য কারও অসুখ-বিসুখে দাদি ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন এবং বেশী করে দোয়া করতে থাকতেন। আমার দাদির কোন শিক্ষকতা যোগ্যতা ছিল না ঠিক, কিন্তু তাঁর ভিতরে মানব হৃদয়োচিত যে মহান আত্মার পরিচয় পেয়েছি তা আমাকে এখন অবাক করে। বাসায় অনেক মেহমান আসত, বিভিন্ন জন দাদির জন্য বিভিন্ন প্রকারের খাবার আনতেন, দাদি আমাকে তা না দিয়ে নিজে খেতেন না। এমনকি আমার শৈশব থেকে কৈশরে পা দেবার পরও দাদি তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাকে পরম স্নেহে ভরিয়ে দিতেন।
আজ দাদি নেই, আমাদেরকে কাঁদিয়ে পরকালে চলে গেছেন। রেখে গেছেন তাঁর অফুরন্ত সুখস্মৃতি। দাদির কথা ভাবতেই বুকটা কেমন হাহাকার করে ঊঠে। বেদনায় ভরে ওঠে এ মনটা। আমার জীবনে দাদির অনুপস্থিতি আমাকে বার বার কাঁদায়, মনে করিয়ে দেয় ছোটবেলার সেই স্মৃতি ---‘আমি দাদির কোলে বসে দুধ—ভাত খাচ্ছি, দাদি আমাকে কত কষ্ট করে কোলে নিয়ে সারাটা পথ ঘুরে ঘুরে আমাকে নিয়ে বেড়াচ্ছেন’। তাই নামাজ শেষে দু হাত তুলে আল্লাহকে বলি, “ইয়া রাব্বুল আলামিন, তুমি আমার দাদিকে সেই চিরস্থায়ী জান্নাত নসিব কর, যিনি আমাকে আমার মায়ের মতোই কষ্ট করে আমাকে শৈশবে লালন পালন করেছেন, আমার আম্মু শত ব্যস্ততার মাঝে আমাকে ঠিক মত সময় দিতে পারেন নি কিন্তু আমার দাদি আমাকে মায়ের অভাব বুঝতে দেন নি, তাঁকে তুমি মাফ করে দিও আল্লাহ’।
Mamun Hasan
[email protected]
New York
United States