অসার অবসান
চৈত্র্য মাসের গনগনে আগুনের মত রোদ্রের মধ্য দিয়ে ফাকা মাঠ বেয়ে অমিত চলল ঘর্মাক্ত আর শ্রান্ত দেহটা নিয়ে। গন্তব্য মামার বাড়ি। সর্বশেষ কবে সে মামার বাড়ি এসেছিল তা কিছুক্ষণ মনে করার চেষ্টা করল অমিত। কিন্তু পারল না। না পারার কারণটা হল অমিত অনেক ছোট বেলায় মামার বাড়ি এসেছিল যা শৈশব স্ম্রতি ধারণের মোটেও উপযুক্ত সময় নয়। যায় হোক, অমিত মাঠ পেরিয়ে বলতে বলতেই গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করল। সুদীর্ঘ ১৫ বছর পর অমিত গ্রামে এল। গ্রামের নাম চন্দনপুর। গ্রামের ছায়াঢাকা, পাখিডাকা, এমন নীরব প্রকৃতি বেশ খানিকটা অবাক করল অমিতকে। আব্বু আর আম্মুর মুখে গ্রামের বর্ননা আর নিজের চক্ষুদীপ্ত গ্রামের মাঝে এক অদ্ভুত মিল খুজে পেল অমিত। এ যেন বিধাতার মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়া এক কারুকার্য।
আব্বুর দেওয়া ডাইরেকশন আর পথচারীর নির্দেশনায় চন্দনপুর পৌছাতে খুব বেশী বেগ পেতে হল না অমিতের। গ্রামের প্রথমেই প্রকান্ড উচু এবং বিরাট এলাকা নিয়ে বাশ বাগান। বাশ বাগান পার হলেই চোখে পড়ে একটা পোড়াবাড়ি, তার ডানদিকে একটু এগিয়ে কাচা রাস্তা ধরে দশ মিনিট হাটলে সামনে বিরাট দীঘি। দীঘির পাড় ঘেসে যে সাদা বাড়ি দেখা যায় এটাই হল অমিতের মামা বাড়ি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন একটা রাজবাড়ি। আসলে কথাটা একেবারে যুক্তিহীন নয় কারণ অমিতের নানা নাকি এ এলাকার সবচেয়ে ধনী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। লোক্ মুখে শোনা- খন্দকার সাহেব নাকি একাই বিরাট এই চন্দনপুর এলাকায় নিজের শাষন প্রতিষঠা করেছিলেন একটানা প্রায় ৩৫ বছর।
বাসার প্রধান ফটকের আগে আটটি মেহগুনি গাছ সারি সারি করে লাগানো। তারপর বাসায় প্রবেশের জন্য সরু পথটি নতুন করে ইট দিয়ে গাথা যেন বাসায় ঢুকতে কোন অসুবিধা না হয়। দরজায় কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে ভারী গলার শব্দ এলো “কে?” উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারলো না অমিত। কিছুক্ষন নীরব থাকার পর বলল অমিত, “আমি অমিত”। “অমিত ক্যাঠা?” আবার ভিতর থেকে শব্দ এল। এবার বেশ আগ্রহের সাথেই অমিত বলল “জি আমি, রুহুল আমীন খন্দকার সাহেব আমার নানা। সাথে সাথে ভুতের মত কালো এবং মোটা একটা লোক খটাং করে দরজা খুলে দিল। বলল, “ছোট সাহেব, আ্পনি? বলেই অমিতকে জড়িয়ে ধরলো। অমিত বেশ বিব্ব্রতকর অবস্থায় পড়লো। লোকটার
মুখ থেকে কি রকম এক বিশ্রী দূর্গন্ধ বের হছিল। অমিত কোন রকমে লোকটার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিল। “সেই কবে আপনারে দেখেছি। মাশাললাহ বহুত বড় আর ডাংগর হয়েছেন” বলল বাসার দারোয়ান মফিজ।
অমিতের নানার বাড়িটা বাইরে থেকে যেমন দেখা যায় ভেতরে অবশ্য তার বিপরীত। ভেতরটা অনেক পরিপাটি আর গোছালো। গেটের সামনে আটটা রজনীগন্ধা ফুলের গাছ। এরপর বাড়ির ভেতরের প্রবেশ পথ। প্রবেশ পথটা বেশ অদ্ভুত। দু পাশে বড় বড় দুটি চৌচালা ঘর আর মাঝখান দিয়ে সরু পথ। হঠাৎ করে অমিতের আলিফলায়লার দস্যু জিগালার গোপন পথের কথা মনে পড়ে গেল। সরূ পথ বেয়ে আর একটু এগোলেই বাড়ির ভেতরের বিরাট উঠান। বাড়ির চার কোণায় বেশ উচু চারটি নারকেল গাছ। আর তার পাশেই পেয়ারা আর আমড়া গাছ দেখা যায়। তারপর সেই পূরনো প্রাসাদ। লোহার দরজায় টোকা দেবার পর একজন মুরুব্বী এক হাতে তসবীহ আর অপর হাতে লাঠি ভর দিয়ে এগিয়ে এলেন, পেছনে একটা মেয়ে। মেয়েটি দরজা খুলে দিতেই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো অমিত। চিনতে কিছুতা দেরী হলেও যখন তিনি জানতে পারলেন তার আদরের নাতি ছেলে অমিত, তখন অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও বার্ধ্যকের নানা অপারগতা সত্তেও অমিতকে বুকে টেনে নিলেম তিনি। বললেন, “এতকাল পর তোদের এই অভাগিনীর কথা মনে পড়লো। তোর আব্বু আম্মুর শরীর কেমন আছে রে?” “নানী আপনি চিন্তা করবেন না ,সবাই খুব ভাল আছে।“ শান্ত ভাবে বলল অমিত। অমিতের আগমনে নানী আফরোজা বেগমের মানুষিক একাকিত্তের কিছুটা অবসান হয়েছে। সেদিন দুপুরে খাবার পর অমিত নানা বাড়ির পেছনে বিরাট আম বাগানের নিচে খাটের উপর বসে ল্যাপটপে “Harry Potter and the half Blood Prince” মুভিটি দেখছিল। কিছুক্ষণ পর তারই সমবয়সী একটা ছেলে তার দিকে এগিয়ে এলো। অমিত কিছু বলার আগেই ছেলেটি খুব আগ্রহ নিয়ে বলল “আসসালামু আলাইকুম, আপনি খন্দকার বাড়ির ছোট সাহেব না?” বলেই ছেলেটি অমিতকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গেল। সাথে সাথে অমিত তাকে বাধা দিল এবং বলল “দেখুন, বংশ মর্যাদা আর আভিজাত্য আমার নানার আমলে ছিল। এখন সে দিন আর নেই। এখন বিজ্ঞানের যুগ। এখন মানুষ কে বড়, কে ছোট আর কে জ্ঞানী তা বিচার করা সম্ভব কেবল মাত্র তার জ্ঞান, যোগ্যতা আর বিচক্ষণতা দিয়ে। বংশ দিয়ে কারো বিচার করার সুযোগ নেই। আমি কি আপনাকে বুঝাতে পারলাম?- ধীরে ধীরে বলল অমিত। জবাবে ছেলেটি ফিসফিস করে বলল, তাইলে, আজ থাইকা আপনি আমার বন্ধু লাগেন, ঠিক আছে? বলেই ছেলেটি দৌড় দিল। কিছু দূর যাবার পর ফিরে এল ছেলেটি এবং বলল, আমার নাম বলতে ভুলে গেছিলাম। আমার নাম সেলিম। জবাবে অমিত হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, “তা তুমি থাক কোথায়?” সেলিম বলল, “ওই যে দীঘিটা দেখছেন, ওটার পরে একটা বাশ বাগান, তার পরেই আমাদের বাসা। অমিত বেশ কৌতুহলের সাথেই বলল, “কি বল, ওই বাশ বাগানের ওপাশে! আমার কিন্তু বাশ বাগানের ভিতর দিয়ে যেতে খুব ভ্য করে।“ অমিতের কথা শুনেই হো হো করে হেসে দিল সেলিম। বলল, “কি বলেন এইডা, আমি ওই বাশ বাগানের মধ্য দিয়া রাত বারোতা একটার দিহে যাওয়া আসা করি,আর দিনের বেলায় আপনি কয়তাছেন ভয় পান। কিছুক্ষণ পর সেলিম অমিতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে গেল।
রোদ্রের আলোর তীব্রতা কমতে শুরু করেছে। আর কিছুক্ষন পরেই সূর্য ঘুমিয়ে যাবে পরবর্তী ১২ ঘন্টার জন্য। অমিত দেখল, মাঠে চাষীরা বাসায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউ কেউ লাঙ্গল-জোয়াল কাধে নিয়ে এরই মধ্যে রুওনা দিয়েছে। ওই দিকে আসরের আজানের সুমধুর ধবণিতে মুখরিত চারদিক। “অমিত ভাই, নানীজান আপনারে ডাহে, “ হঠাত চমকে উঠল অমিত। পেছন ফিরে দেখল একটি মেয়ে । “ঠিক আছে, যাও আসছি”- একটু বিরক্তির সুরেই বলল অমিত।
আসরের নামাজের পর মামাতো ভাই মাহমুদের সাথে প্রথম পরিচয় হল অমিতের। অদ্ভুত মানুষ মাহমুদ। ছন্দ বা কবিতা ছাড়া সে কোন সময় কথা বলে না। নানীর কাছ থেরে অমিত জানতে পারলো যখন মাহমুদ ক্লাস এইটে পড়ত, তখন একবার বাংলা পরীক্ষায় সে কবিতা লিখতে ভুল করেছিলো। তাই তার স্যারেরা তাকে বেশ বকেছিল। তার পর থেকে মাহমুদ আর কোনদিন ছন্দ ছাড়া কথা বলেনি।
মাহমুদঃ কেমন আছেন অমিত ভাইয়া
অনেক দিন পর দেখা,
এতদিন দেখা হয় না কষ্টে ছিলাম একা।
অমিতঃ না, না, আমার কোন সমস্যা নেই, আমি আল্লাহর রহমতে ভালোই ছিলাম। এখন তোমার খবর কি বল?
মাহমুদঃ গিয়েছিলাম চন্দ্রীমাপুর
আমার খালার বাসা--
আসতেই দিবে না কি আর করব
সাতদিন পর আসা।
অমিতঃ ও আচ্ছা, খালার বাসায় তাহলে তো অনেক আনন্দ আর খাওয়া দাওয়া হয়েছিল।কি বল?
মাহমুদঃ যাই হোক অমিত ভাই,
চলুন তবে অন্য কোথাও যাই।
সেদিন সন্ধ্যায় অমিত আর মাহমুদ গ্রামের কিছু লোকের সাথে পরিচিত হল যারা গ্রাম থেকে যুব উন্নয়ন- এর প্রশিক্ষণ নিয়ে পুকুরে মাছের ঘের দিয়েছে। তাদের কাছ থেকে সে আরও জানতে পারল , প্রাথমিক ও মাধ্যমিচ স্তরের শিক্ষা শেষ হবার পর আর্থিক সমস্যার কারণে তাদের পক্ষে আর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি। কিছু দিন বেকার জীবন যাপনের পর এলাকার যুব উন্নয়ন বোর্ডের সহযোগিতায় তাদের একটা স্থায়ী সমাধান হয়েছে। এদের মধ্যে মামুন নামের একটা ছেলেকে অমিতের বেশ ভাল লাগলো। তার সাথে অনেক সময় ধরে কথা বলল অমিত। মামুনের কথা থেকে বেরিয়ে এল,পড়াশোনা না হবার আক্ষেপ, ক্লাসে ভাল ছাত্র হওয়া সত্তেও কেবল মাত্র বাবাব্র আর্থিক অসচ্ছলতার কারনে এস এস সি পাশের পর আর কলেজে পা বাড়াবার সুযোগ হয় নি তার।অনেক কষ্টে পরীক্ষার টাকা জোগাড় করেছিল সে, এবং পরীক্ষা দিয়ে ভাল রেজাল্টও করেছিল মামুন।বাবার অসুস্থ শরীর নিয়ে পেরে না উঠায় বাধ্য হয়ে সংসারের হাল ধরতে হয়েছে মামুনের। রাত্রে দেরী করে বাসায় ফেরার জন্য নানীর কাছে একটূ আদরীয় বকা শুনতে হল অমিতের। খাওয়া শেষ করে ক্লান্ত দেহটা নিয়ে ঘুমিয়ে গেল অমিত।
ফজরের নামাজের পর নানীর সাথে দেখা করার জন্য ঘরের বাইরে পা বাড়াল অমিত। আচমকা কাজের মেয়েটির সাথে দেখা হল অমিতের। “সরি”- বলল্ অমিত। জবাবে মেয়েটি সাথে সাথে মুখটা আচলের আড়ালে লুকাল, বলল, “নানীজান আপনারে নাস্তা করার জন্য ডাকে”বলেই দরজার বাইরে পা বাড়াতে উদ্দত হল। “আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি”- আচমকা প্রশ্নে হঠাত থামল সে। “কি বল্বেন, বলে ফেলান।“ বলল মেয়েটি। “জি, আসলে গত দুই সপ্তাহ যাবত আপনাকে দেখছি এ বাড়িতে অথচ আপনার পরিচয়টা জানতে পারলাম না, অনেক দিন পর এ বাড়িতে আসছি তো তাই কাঊকে তেমন চিনতে পারছি না।“ বলল , অমিত। “আমার নাম নিশি” – বলেই মেয়েটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
নানীর পাশে বসে নানীর কাছে গল্প শুনতে ভালোই লাগছিল অমিতের। ঘরের বারান্দায় সকালের নরম রোদ যেন আড়ি পেতে বসে আছে। রোদ গায়ে লাগতেই কিছুটা আরাম বোধ করল অমিত কারন সকালের হাল্কা হীম শীতল বাতাসে কিছুটা ঊষ্ণতার প্রয়োজন হয়। হঠাত মাহমুদ এসে হাজির হল।
অমিত আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছ মাহমুদ?
মাহমুদঃ ওয়ালাইকুম আসসালাম
আপনার কাছেই আসলাম
পাশের গ্রামসে যাব ভাবছিলাম
সঙ্গে নিতে আপনাকে চলে এলাম
যদি যেতে চান এখনি পা বাড়ান।
“এই তো আমার কবি সাহেব চলে এসেছেন, এখন যাও, ওর সাথে গ্রাম দেখে এসো।“ নানীর হ্যা সূচক মাথা নাড়ানো দেখে পা বাড়াল অমিত।
হাসিমপুর গ্রামটি চন্দনপুর গ্রাম থেকে অনেকটা আলাদা। গ্রামের দক্ষিণপূর্ব দিকটা অনেকটা ফাকা পড়ে আছে। সেখানে মানুষের আনাগোনা তেমনটা দেখা যায় না। বিরাট মাঠের মাঝখানে একটা ছোটখাটো অট্টালিকা। অনেকটা পোড়াবাড়ির মত। তার চারপাশে অনেকগুলো আম গাছ লাগানো ছিল। গ্রামের পশ্চিম পাশে মানুষের বসবাস বেশি। গ্রামের সরু রাস্তা গ্রামটিকে দুভাগে বিভক্ত করেছে। অমিত আর মাহমুদ সেই সরু রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করলো। রাস্তার পাশের বাড়িগুলো কাচা আর খড়ের ছাঊনি দেওয়া। হাসিমপুর গ্রামে খুব বেশি টিনের ছাঊনি দেউয়া বাড়ি নেই, হয়ত হাতে গোনা দু একটি।
মাহমুদঃ আমরা এখন হাসিম পুরে
চন্দনপুর থেকে নয় বেশি দূরে।
গ্রামটা দেখতে কিছুটা ভিন্ন
সামনে চলুন দেখবেন আরো চিনহ
অমিতঃ আচ্ছা, গ্রামের এই দিকটা কেমন যেন নিরিবিলি, গাছপালায় পরিপূর্ণ, আর মানুষের এমন যাতায়াত নেই কেন, বলতে পারো?
মাহমুদঃ সে তো অনেক কথা অমিত ভাই
আপনাকে না হয় পরে বলি
এখন তবে সামনে যায়।
দেখতে দেখতে অমিত আর মাহমুদ গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে চলে এলো। এলাকাটি অমিতের অনেক ভাল লাগলো। সামনে বিশাইহরি খাল। খালটা তেমন চওড়া বলে মনে হয় না তবে গভীর আছে। গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গ্রামের আংশিক ভিতর দিয়ে চলে গিয়ে, আবার দক্ষিণ দিকে সরে গিয়ে পূব দিক মোড় নিয়ে গ্রামের অপর প্রান্তে গিয়ে কিছুটা চওড়া হয়ে হরিনাথপুর গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে গেছে।
মাহমুদঃ এই খাল নিয়ে কথিত আছে বিরাট এক কাহিনী
একদা এক রাজা ছিলেন সঙ্গে নিয়ে বাহিনী
রাজা প্রজা রাজকন্যা সবি ছিল তার রাজ্যে
কেবল মাত্র সুপানীয় ছিল না রাজার সাধ্যে
রাজ্য জুড়ে পানির অভাব লোক মরে দলে দলে
রাজা ভাব্লেন দীঘি কাটবেন নানান ছলে বলে
শত শত শ্রমিক আর শত শত দিনমজুর
কাটতে লাগলো দীঘি সকাল, বিকাল রাতদুপুর
সাত দিন সাত রাত কেটে গেল তবে
এক ফোটা পানি নেই এখন কি হবে
রাজা পড়লেন মহাচিন্তায় কি করবেন এখন
মন্ত্রী বললেন জাহাপনা! দরবেশ সাহেবের ডাকেন
সবই শুনে দনবেশ সাহেব দিলেন একটা শর্ত
যেটার মূল্য রাজার কাছে ঢের চেয়েও অর্থ
দরবেশ বললেন মাফ করবেন হুজুর
নামিয়ে দিন আপনার কন্যা জলে ভরবে পুকুর
রাজা ছিলেন দয়ালু তার প্রজাদের প্রতি
নামিয়ে দিলেন কন্যাকে অপরূপা সুমতি
শুরু হল দারুণ খেলা ভরল পুকুর জলে
রাজকুমারী হারিয়ে গেল অথেয় পানির তলে।
গল্পটা দারুণ ভাল লাগলো অমতের। তার মনটা কেমন যেন উদাসী হয়ে গেল। সে ভাবতে লাগল রাজকুমারীর কথা, কেমন সে অকাতরে মানুষের কথা ভেবে নিজের জীবন বিলিয়ে দিল। সে কেমন দয়াবান আর উদার মনের মানুষ। হঠাত রাস্তায় হালকা হোচট লেগে অমিতের উদাসীন্তা কেটে গেল। সে আকাশের দিকে তাকাল। নীলাকাশ, সূর্যের প্রখর উত্তাপ অমিতের মুখটাকে যেন ঝলসে দিতে চায়। বেশিক্ষণ তাকাতে পারল না সে। বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হল অমিত আর মাহমুদ।
দরজায় খট খট শব্দে ঘুম ভাংল অমিতের। ঘুমের ঘোরেই অমিত বলল, কে? জবাবের অপেক্ষা করছিল অমিত, কোন সাড়া না পেয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা খুলে দিল সে। দরজার সামনে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। চেহারাটা তেমন পরিচিত মনে হল না অমিতের। তারপরও অমিত বল, “জি কিছু বলবেন?” জবাবে মেয়েটি বেশ আগ্রহের সাথে বলল, আপনি , অমিত ভাইয়া তাই না? জবাবে অমিত হ্যা সূচক মাথা নাড়ল। মেয়েটি বলতে শুরু করল, “আমাকে আসলে আপনি চিনবেন না কারণ আপনি এর আগে কখন আমাকে দেখেন নি, আমার নাম সিনথিয়া। আমি আপনার ছোট মামার মেয়ে। আমি মামুনের বোন।“ “ও আচ্ছা, তা কেমন আছ তুমি? তারপর কি খবর বল?” জবাবে মেয়েটি বলল, “আসলে আমার মা অর্থাৎ আপনার মামী আপনাকে একটু দেখতে চান তাই তিনি আমাকে পাঠেয়েছেন আপনাকে নিয়ে যেতে। হ্যা সূচক মাথা নাড়ল অমিত তারপর হালকা কিছু গোছগাছ করে সে সিনথিয়ার সাথে মামীর সাথে দেখা করতে গেল।
ছোট মামার বাসাটা বেশ ভাল লাগল অমিতের। চারদিকে বেশ গোছালো ভাব। বাড়ির চারদিকে বেশ কয়েকটা বকুল গাছ। অমিত সেই বকুলের সুবাস পেল। বাড়ির সামনে একাটা মাঝারি সাইজের দীঘি। দীঘিতে পদ্ম ফুলের বাহার। বাড়িতে প্রবেশ করতেই অমিত কেমন যেন এক নির্জনতা অনুভব করল। আরেকটু এগোলেই অমিত দেখতে পেল ঘরের বারান্দায় একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। অমিতকে দেখা মাত্রই দ্রুত নেমে এসে অমিতকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। আর ফুপিয়ে কাদতে কাদতে বললেন,” আজ প্রায় ১৫ বছর পর তোকে দেখছি। তুই তো অনেক বড় হয়ে গেছিস রে। আয় ঘরে আয় বস।“ মামীর আদরে আর স্নেহে মুগ্ধ হল অমিত। অমিত ঘরের ভিতরে বসে ছিল। কিছুক্ষণ পর অমিতের মামাত বোন সিনথিয়া এসে প্রায় জোর করেই অমিতকে হাত ধরে নিয়ে ঘরের পেছন দিক দিয়ে দরজা খুলে বাইরে নিয়ে গেল। অমিত কিছু বুঝে উঠার আগেই তারা তার নানীর বাড়ির কাছে পৌছে গেল। অমিত হাফাতে হাফাতে বলল, “কি ব্যাপার বলুন তো, আমাকে এখানে নিয়ে এলেন কেন? কি হয়েছে?” “ এখন সময় নেই , আমি আপনাকে পরে সব খুলে বলব”-বলেই মেয়েটি অমিতের চোখের আড়াল হল। বিষয়টা অমিতের কাছে একটু আশ্চর্য মনে হল।
বাসায় ফেরার পথে হঠাত মামুনের সাথে দেখা হল অমিতের। কুশলাদি জানবার পর অমিত মামুনের ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয় জানতে চাইল। জবাবে মামুন তাকে বেশ আনন্দের সাথে তার ব্যবসার লাভ লোকসানের হিসাব করছিল। নাতীর শুকনো মুখটা দেখে বেশ মায়া হল আফরোজা বানুর। “এতক্ষণ কোথায় ছিলি রে অমিত? আদরের সাথে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি। অমিত থতমত খেয়ে বলল, “জি, আ-আমি পাশের ঐ বাগানে একটু হাটছিলাম।“ বলেই নিজের ঘরের দিকে মুখ করল অমিত। ঘরের ভেতর প্রবেশ করতেই অমিতের চোখ তো ছানাবড়া। বেশ অবাক হল সে। দেখল, তার ঘরটা কে যেন অতি চমতকারভাবে সাজিয়েছে। অমিতের বালিশটা বিছানার নিচ থেকে খাটের এক কোণায় রাখা হয়েছে, তার পরার লুঙ্গিটা বিছানা থেকে কেমন সুন্দর আলনায় শোভা পাচ্ছে। জানলার পর্দাটা আর এলোমেলো নেই, দারুণ ভাল লাগল তার, অমিত মনে মনে নিশির উপর বেশ খুশি হল। কিন্তু বিকালের ঘটনাটা অমিতকে বার বার পীড়া দিচ্ছিল। অমিত বিছানায় তার ক্লান্ত দেহটা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগল তাহলে কি সিনথিয়া এবং মামী আমাকে পছন্দ করে না? কিন্তু পরক্ষণেই মামীর স্নেহভরা ডাক আর আদরের কথা মনে পড়ল অমিতের। “ কিন্তু কেন সিনথিয়া আমাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে এল? তবে কি সেও আমাকে তার মায়ের মতই……এতসব জল্পনা কল্পনা আর ভাবনার পর অমিতের চোখের পাতা এক সময় ভারী হয়ে এল। পরক্ষণেই ঘুমের দেশে পাড়ি দিল অমিত।
“আসলে আমার বাবার মাথার সমস্যাটা শুরু হয় দাদাজানের মৃত্যুর পরপরই। আমার বাবা দাদাজানকে অনেক অনেক ভালবাসতেন। মৃত্যুর আগের দিন দাদাজান যখন খুব অসুস্থ ছিলেন, তখন আমার বাবা ছিলেন ভারতে তার ব্যবসায়িক কাজে। আর তখন তো এমন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না তাই চাচারা আমার বাবাকে জানাতে পারে নি। দাদাজানের মারা যাবার দু সপ্তাহ পর বাবা বাসায় আসেন। তারপর সব কিছু শুনে তিনি জ্ঞান হারান। দুই দিন পর তার জ্ঞান ফেরে। তবে বাবা তার পেছনের সব স্মৃতি ভুলে যান। তিনি বাসার কাঊকে চিনতে পারতেন না। এরপর অনেক ডাক্তার কবিরাজ দেখান হয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয় নি। আর সেদিন আপনাকে যে হঠাত করে বাইরে নিয়ে আসলাম এর কারণ হল আমার বাবা ঠিক ঐ সময় বাসায় আসছিলেন। তিনি কোন অপরিচিত মানুষ দেখতে পারেন না। দেখলেই তিনি মনে করেন সে বুঝি তার বাবাকে মেরে ফেলেছে। তাই তিনি তাকে মারতে আসেন। মা আমাকে বলেছিল আপনাকে নিয়ে চলে যেতে যেন কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে”—কথাগুলো সিনথিয়া বলছিল অমিতকে, বিকালে নাস্তা করার সময়। অমিতের মনটা খুব খারাপ লাগল ছোট মামার জন্য। অমিতের পাশে মাহমুদও ছিল। এমন সময় অমিতের মুঠো ফোন্টি চিতকার দিল “Baby, look there is a shark in the water.” আর পর্দায় অমিতের আব্বুর ছবি। “ নানীর কাছে থাকতে থাকতে আব্বু আম্মুর কথা ভুলেই গেছ নাকি?”বলছিলেন আরিফ সাহেব ঢাকা থেকে। “ কি যে বলেন আব্বু, এখানে অনেক আনন্দ আর ইনযয় করছি।“ অমিত বলল। আরোও কিছুক্ষণ আলাপ করে ফোন রাখল অমিত। ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল। চারদিকে অন্ধকারাচ্ছন্নতা ঘিরে ধরেছে সবাইকে। এদিকে নিশি এসে খবর দিল অমিতকে নানী আফরোজা বানু ডাকছেন। নাগরিবের আজানের সুমধুর সুর ভেসে এল পাশের মসজিদ থেকে। সিনথিয়া আর মাহমুদও তাদের বাড়ির দিকে রওনা দিল।
মাররিবের নামাজের পর আফরোজা বানু অমিতকে কাছে ডাকলেন কিছু কথা বলার জন্য। বিরাট বাড়ির বারান্দায় অমিত ও তার নানী সোফায় বসে ছিল। আফরজা বানু একটি হতাশার দীর্ঘশাস ফেলে বলতে শুরু করলেন। “দেখ, আমার তিনটা ছেলে। আর দুইটা মেয়ে। তোমার বড় মামা খব্দকার আব্দুল লতিফ অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল হয়েছে আজ প্রায় ১৫ বছর। তারা এখানে আর কখন আসবে বলে আমার মনে হয় না। সেখানে যাবার পর আমার কাছে তারা কোনদিন একটি চিঠিও পাঠায় নি। আমি জানি না তারা কেমন কি হালে আছে। আমার মেজ ছেলে খন্দকার শরীফ মাহমুদ। পাচ বছর হল ঢাকা থেকে আসার সময় এক রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। বলেই ফুপিয়ে কেদে উঠলেন আফরোজা বানু। আবার শুরু করলেন তিনি, “কত সহজ সরল ছেলে ছিল আমার সে। আমি যা বলতাম সে তাই শুনত। প্রতিদিন কাজ থেকে বাসায় এসে সে আগে আমার কাছে আসত, তারপর সে তার বাচ্চাদের কাছে যেত। আর খন্দকার আশফাক-তোমার ছোট মামা। তোমার নানার মৃত্যুর প্রায় তিন সপ্তাহ পরে তার ব্রেণে কি সমস্যা হয়েছিল এখন সে পাগল হয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর আমার মেয়েদের কথা কি বলব, তোমার বড় খালা লতিফা বেগম, আজ প্রায় ১০ বছর কোরিয়া চলে গেছে ওর ফ্যামিল্ নিয়ে। মাঝে মধ্যে দু একটি চিঠি পাঠায় , আমার শরীরের খোজ খবর নেয়। সেও কবে সবে কি আসবে না তা আমি জানিনা। আর তোমার মায়ের কথা আর কি বলব। তিন বছর আগে একবার এসেছিল কিন্তু দু দিনের বেশি আর থাকল না। আমার বয়স হয়েছে। কখন কি হয়ে যায়। এ সময় তারা যদি সবাই আমার পাশে থাকত তাহলে আমার কতই না ভাল লাগত।“ আফসোসের সাথেই বললেন তিনি। “আমার নাতি-পুতিরা সবাই আমার সামনে ঘুর ঘুর করবে, খেলা করবে, হাসবে, এগুলো দেখতে কি আমার একটু ও ইচ্ছা করে না- বেশ অভিমানের সাহেই বললেন আফরোজা বানু। সবাই বলে আমার সময় নেই, আমার সময় নেই। আসলে আমি মারা গেলে- “ও কথা বলবেন না নানীজান। হঠাত করেই অমিত বলল। আসলে জন্মের পর থেকেই বড় হয়েছি আব্বু আর আম্মুর কাছে, সেই জন্য আমার পৃথিবীতে আমি কেবল এই দু জন মানুষকেই চিনি যারা আমার মঙ্গল চান, কিন্তু এখানে এসে আমার ধারণাটা পুরো পরিবর্তন হয়ে গেল। আসলে মা বাবা ছাড়াও পরিবারের আরোও অনেক ব্যক্তি থাকের যারা সব সময় আমাদের জন্য দোয়া আর মঙ্গল কামনা করেন।“
“তোমার কোন দোষ নেই নানুভাই, কান্না জড়ান কন্ঠে বললেন আফরোজা বানু। এই যে বিরাট বাড়ি দেখছ, আমি একা থাকি। আমার দম যেন বন্ধ হবার উপক্রম হয়। আমি আর নিশি বসে বসে সারাদিন কত গল্প করি। আর যখন নিশি থাকে না তখন আমি একা একা পাখির সাথে, গাছের সাথে, ঘরের সাথে কথা বলি। আজ আমি একটা কথা বলার মানুষ পায় না। আজ আমার সব থেকেও নেই। আমি শুনেছি, তোমার বাবা ফোন করেছিল তোমাকে। আগামীকাম অথবা পৌরশো দিন তোমাকে চলে যেতে হবে। তুমি যাও, আমি বাধা দেব না। কথাগুলো বললাম মনের কষ্টটা কিছুটা হলেও হালকা করার জন্য। যেদিন তুমি এ বাড়িতে এসেছিলে সেদিন থেকে আমি অনেক আনন্দিত আর খুশি ছিলাম। তোমার চলে আবার খবর শুমে মন্টা আমার খুব খারাপ। আমি আবার আসবো নানীজান আর এবার এলে আব্বু আর আম্মুকেও সাথে করে নিয়ে আসব, আপনি কোন চিনতা করবেন না। নানীর হাতে হাত রেখে আনেক্টা শান্তনার সুরে বলল অমিত। আর তোমার আব্বু, তারা আমার কথা ভুলেই গেছে। দীর্ঘ শাস ফেললেন আফরোজা বানু। নানীর সাথে আলাপ সেরে অমিত নিজের ঘরের দিকে গেল।
দরজায় খট খট আওয়াজটা বেশ জোরাল মনে হল অমিতের। বেশ বিরক্তির সুরেই বলল, “কে?” দরজার ও পার থেকে বেশ চটচটে গলায় আওইয়াজ এল, “অমিত ভাই, দরজা খোলেন ঘর পরিষ্কার করব।“ দরজা খুলে দিতেই নিশি হন হন করে ঘরের ভেতর ধুকে ঝাড়ু দিতে আরম্ভ করল। তারপর, আলনার কাপড় গোছ গাছ করে সে চলে গেল। দরজা খোলায় ছিল। সকালের নরম রোদ অমিতের গায়ে লাগল। ঘুম ঘুম চোখে বাইরে তাকাল অমিত। মনে মনে ভাবল, আজকের দিনটা মনে হচ্ছে ভাল যাবে। এমনটা মনে হাবার কারণটা হল সে ঐ বাক্যটিতে বিশ করে আর হল, “Morning shows the day.” অর্থাৎ “ঊষালগ্নেই দিবসের প্রতিচ্ছবি।“ সকালের নাতিশীতোষ্ম পরিবেশে কম্বলের ভেতর থেকে উঠতে চাচ্ছিল না অমিত। কিন্তু শরীর আর মনের বিছানা থেকে উঠা না ঊঠার যুদ্ধে অবশেষে মন বিজয়ী হল। বিছানা ছেড়ে উঠেই সোজা বাথ্রুমে গেল অমিত। ফিরে এসে দেখল নিশি নাস্তা দিয়ে এসেছে। নাস্তা করার সময় অমিত নিশিকে জিজ্ঞাসা করল, “তা তোমার বাসা কোথায়?” জবাবে বেশ অকপটে নিশি বলল, “আপনাদের বাড়ির পেছনের দিকে যে আম বাগান সেটা পার হয়ে পশ্চিম পাশের বাশ বাগানের দিকে আমাদের বাসা।“ আচ্ছা, তোমাদের বাসাটা কি সেলিমদের বাশার আশে পাশে?” বেশ আগ্রহের সাথেই গিজ্ঞাসা করল অমিত। “কি যে বলেন, অমিত ভাই উনি আমার সামী”- বলেই লজ্জায় মুখ ধাকতে ধাকতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নিশি।
বিকালের দিকে অমিত একা একা হাটতে বের হল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে আবিষ্কার করল তার মনটা কেন জানি খারাপ। নানীর কথন গুলো অমিতের কানে যেন বার বার বাজতে লাগল। নিজেকে কিছুতা অপরাধী মনে হল তার।
তিন দিন পর
আজকের সকালটা তেমন রোদ্রকর উজ্জ্বল মনে হল না অমিতের কাছে। আকাশের দিকে উকি দিল অমিত। আজকের আকাশটা কেমন যেন গোমড়া হয়ে আছে । সকালে সূর্যের কোন চি্নহ নেই। ঘন মেঘে সারা আকাশ ছেয়ে আছে। আজ খুব বৃষ্টি হতে পারে মনে মনে ভাবল অমিত । তাই বাইরে যাবার তেমন ইচ্ছা হল না তার। ভাবল, নানীর কাছ থেকে একটু ঘুররে আসি।
নানীকে আসময়ে শুয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হল অমিত। কাছে গিয়ে কপালে হাত দিতেই আসল ব্যাপারটি বুঝল সে। “এ কি নানীজান আপনার গায়ে তো অনেক জর। কখন , কিভাবে হল?” বেশ বিচলিত হয়েই জানতে চাইল অমিত। “নাহ, এরকম জর সর্দি আমার তো প্রায় আসে, চিন্তা করিস না ঠিক হয়ে যাবে।“ কাতর কন্ঠে জাবাব্ব দিলেন আফরোজা বানু। “কিন্তু তারপর ও আমাকে একটু জানান নি কেন আর কখন থেকে এরকম হয়েছে? একটু অভিমানের সুরেই বলল অমিত। জবাবে মুচকি হাসলেন আফরোজা বানু বললেন, ইনশাআল্লা্ সব ঠিক হয়ে যাবে বলেই খুক খুক করে কেশে দিলেন তিনি। অমিত অনেকক্ষণ ধরে নানির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর অমিত হঠাত লক্ষ্য করল নানী নীরবে কাদছেন। অমিত ছোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল নানীজান আপনি কাদবেন না দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
আনুমানিক দুপুর বারটার দিকে আকাশ পুরোপুরি কাল মেঘে ধেকে গেল। ভর দুপুর বেলা যেন মুহুর্তেই ঘন অন্ধকারময় সন্ধ্যায় পরিণত হল। পরক্ষণেই প্রচন্ড বেগে বৃষ্টি আর ঝড় শুরু হয়ে গেল। অমিত নানীর পাশে বসে ছিল আর পাশে নিশি। ঝড়ো বাতাস যেন সব কিছু উলটে পালটে দিতে চায়। বাতাসের শো শো শব্দে প্রকৃতির সব কিছু যেন স্তব্ধ প্রায়। জানালা দিয়ে উকি দিল অমিত। দেখল, দূরের আম,কাঠাল আর মেহগুনী গাছগুলো যেন এক উন্মত্ত খেলায় মেতেছে। কে কাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারে এমন প্রতিযোগিতা বুঝি। রাত আটটার দিকে ঝড়ের বেগ কিছুতা কমলেও অঝর ধারায় বৃষ্টি এখন পড়ছে। অমিত আজ সারা দিন অসুস্থ নানীর সেবা যত্নে কাটিয়েছে। নানীকে খাওয়ানো, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া সবই করেছে অমিত। আফরোজা বানু ঘুমাচ্ছেন নিশি এসে অমিতকে খবর দিল, সে বসে ছিল পাশের রুমে। আফরোজা বানুর শরীর খারাপ শুনে নিশি আজ খুব ভোরে এসেছিল ঝড়ের কারণে সে সারাদিন ব্বাসায় যেতে পারি নি অথচ সে তার সামীকে ছাড়া কোনদিন খাওয়া দাওয়া করে না।
রাত তিন্টার দিকে আফরোজা বানুর শরীরটা আরো খারাপ হয়ে গেল। তিনি তার বুকের বার পাশে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলেন। অমিত নানীর পাশে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ছিল। এত রাতে এই ঝড় বৃষ্টির সময় সে কি করবে বুঝতে পারল না। একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে নানীর হাত ধরল অমিত, বলল, নানীজান আপনার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে? জবাবে আফরোজা বানু হাত ইশারা করে কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু পারলেন না।
ভোর পাচটার সময় আফরোজা বানু ইন্তেকাল করলেন। অমিত আর নিশি বুক ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। অমিত যেন চোখে ঘোর আন্ধকার দেখছিল। সকাল নাগাত পুরো এলাকায় মৃত্যুরখবর ছড়িয়ে পড়লো এবং কান্নার রোল পড়ে গেল। ওই দিন বিকালে অমিতের আব্বু আর আম্মু এসে পৌছাল। কান্নার মহারোলে এলাকার বাতাস যেন ভারী মনে হচ্ছিল।
মামুন হাসান